ড. এস কে আকরাম আলী, মুক্ত বাংলাঃ
সাম্প্রতিক **জুলাই বিপ্লব ২০২৪** দেশ, সমাজ ও রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তবে এই বিপ্লবের চেতনা এবং জনগণের আকাঙ্ক্ষা এখনো পূর্ণতা পায়নি। ঐক্যের মাধ্যমে অর্জিত যা কিছু ছিল, তা এখন দুর্বল ও ভঙ্গুর বলে প্রতীয়মান হচ্ছে, এবং এর ফলে বাংলাদেশের মানুষের মনে গভীর উদ্বেগ ও অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, দেশ, সমাজ এবং রাজনীতি অদূর ভবিষ্যতে ভারতের আধিপত্যবাদী রাজনীতির লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হতে পারে, যার স্থানীয় এজেন্টদের তৎপরতা ইতোমধ্যেই দৃশ্যমান।
পতিত ফ্যাসিবাদী শাসকের অনুসারীরা সরকারে বিদ্যমান দুর্বলতা ও অনৈক্যের সুযোগ নিয়ে দেশে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটাতে চেষ্টা করবে। আমাদের সমাজ স্বাধীনতার পর থেকেই বিভক্তির শিকার। শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা ছিল অস্পষ্ট, যা জনগণকে এক ধরণের বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে রেখেছিল। স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ে গোটা সমাজ ছিল এক অনিশ্চয়তার আবরণে। যদিও শেখ মুজিবের ৭ই মার্চ ১৯৭১-এর ভাষণ সমাজে ব্যাপক আলোড়ন তোলে, তবে তা ছিল একটি দিকনির্দেশনাহীন আবেগঘন ভাষণ। তিনি ২৫ মার্চ ১৯৭১ পর্যন্ত জনগণকে অনিশ্চয়তার মধ্যে রাখেন, যেদিন পাকিস্তানি জান্তা পূর্ব বাংলার নিরস্ত্র জনগণের ওপর বর্বর হামলা চালায়।
এই জাতীয় সংকটকালে, **মেজর জিয়াউর রহমান** ছাড়া আর কেউ নিজের এবং নিজের পরিবারের (যার মধ্যে দুই শিশু সন্তানও ছিল) জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে আসেননি। ২৭ মার্চ ১৯৭১-এ তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। অন্যদিকে শেখ মুজিব পাকিস্তান আর্মির কাছে আত্মসমর্পণ করেন, দেশবাসীকে জান্তার দয়ায় ফেলে রেখে। আওয়ামী লীগের অন্য শীর্ষ নেতারা সীমান্ত পার হয়ে ভারতে আশ্রয় নেন।
ভারতের দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষিত সুযোগটি এসে যায় এবং তারা এক মুহূর্তও বিলম্ব না করে নিজেদের স্বার্থে এগিয়ে আসে। আমরা ভারতের কৌশলের বলি হই, যদিও লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়। স্বাধীনতার শুরু থেকেই ভারত বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে এবং এটি ছিল এক প্রকার সীমিত স্বাধীনতা, যতক্ষণ না **জিয়াউর রহমান** ১৯৭৫ সালের নভেম্বরের শুরুতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে দৃশ্যমান হন।
তাঁর নেতৃত্বে সমাজ ও রাজনীতিতে আমূল পরিবর্তন আসে এবং ভারতীয় আধিপত্য থেকে বেরিয়ে আসে বাংলাদেশ। তিনি কার্যকর একটি রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার প্রবর্তন করেন এবং বহুদলীয় গণতান্ত্রিক চর্চার মাধ্যমে রাজনীতিকে শৃঙ্খলার পথে ফেরান। ‘**বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ**’ নামক এক নতুন জাতীয় পরিচয়ের মাধ্যমে বিভক্ত সমাজ প্রথমবারের মতো ঐক্যবদ্ধ হয়। এটি ছিল জাতিকে অস্থিরতা থেকে স্থিতিশীলতার দিকে নিয়ে যাওয়ার এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ, যা ভালোভাবে চলছিল যতক্ষণ না ২০০৮ সালে **শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ফ্যাসিবাদী শাসন** শুরু হয়।
এরপর দেশ, সমাজ ও রাজনীতিতে এক বিপর্যয় নেমে আসে। সমাজকে কৃত্রিমভাবে বিভক্ত করা হয় ‘মুক্তিযুদ্ধপন্থী’ ও ‘বিরোধী শক্তি’ হিসেবে। তথাকথিত মুক্তিযুদ্ধপন্থীরা, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সমাজে শ্রেষ্ঠত্ব ও অগ্রাধিকার ভোগ করতে থাকে। অপরদিকে বিএনপি, জামায়াত ও অন্যান্য ইসলামপন্থী দলসমূহের নেতা-কর্মীরা নানা দমনপীড়নের শিকার হন। তাদের নাগরিক অধিকার হরণ করা হয়, এবং দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ধর্মনিরপেক্ষতার নামে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির মাধ্যমে ইসলামী চর্চাভিত্তিক দেশীয় সংস্কৃতি ধ্বংসের চেষ্টা চলে।
এই সময়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বলতে ছিল কেবলমাত্র আওয়ামী লীগকেন্দ্রিক সবকিছু। বিএনপি ও জামায়াতের রাজনীতি ধ্বংস করে দেওয়া হয় হত্যা, গুমসহ নানা নিষ্ঠুর উপায়ে। এ ছিল এক দলীয় কর্তৃত্ববাদী শাসনের যুগ। সংসদীয় ব্যবস্থা নামক একটি ছদ্মাবরণে প্রধানমন্ত্রী সব ক্ষমতা নিজের হাতে কেন্দ্রীভূত করেন এবং একনায়কে পরিণত হন। সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনীতির সব প্রতিষ্ঠান ছিল ফ্যাসিবাদী শাসকের আজ্ঞাবহ।
কিন্তু **২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব** ছিল সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে নিপীড়িত জনগণের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ, যা দেশ, সমাজ ও রাজনীতিকে মেরামতের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এই তিন ক্ষেত্রে সংস্কার একান্ত প্রয়োজন এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা সম্পন্ন করতে হবে। একসাথে সবকিছু করা সম্ভব নয়, তবে যে মৌলিক পরিবর্তনগুলো অত্যাবশ্যক, তা এখনই করা উচিত, আর বাকিগুলো পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত। একটি সমাজ পরিবর্তন করতে হলে সময় লাগে এবং তা করতে হয় শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশের মাধ্যমে। তবে এ বিষয়ে এখনো দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখা যায়নি।
একটি রাষ্ট্র পরিচালিত হয় তিনটি শাখার মাধ্যমে—**কার্যনির্বাহী, বিচার বিভাগ ও আইনসভা**। সুশাসনের জন্য এই তিনটির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে হয়। যদি আমরা সংসদীয় ব্যবস্থার পথে যাই, তবে সংসদকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ কর্তৃত্বে আনতে হবে। নতুন কিছু উদ্ভাবনের চেয়ে যুক্তরাজ্যের বহু শতাব্দী পরীক্ষিত ব্যবস্থাকে অনুসরণ করাই শ্রেয়। রাষ্ট্রপতির হাতে সীমিত কিছু ক্ষমতা দেওয়া যেতে পারে, যা প্রধানমন্ত্রী পরিচালিত সরকারের স্বাভাবিক কার্যক্রমে বিঘ্ন সৃষ্টি করবে না। বিচার বিভাগ স্বাধীন হওয়া উচিত, তবে বিচারক হিসেবে নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্যতা ও চরিত্রের ভিত্তিতে প্রার্থীদের নির্বাচন করতে হবে, তা সে নিম্ন আদালত হোক কিংবা উচ্চ আদালত।
কার্যনির্বাহী বিভাগকে যথাযথ ক্ষমতা দিয়ে পরিচালনার সুযোগ দিতে হবে এবং এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি শাসন ব্যবস্থা আমাদের দেশের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত বলে প্রতীয়মান হয়। বাংলাদেশের মতো দরিদ্র রাষ্ট্রের জন্য উচ্চকক্ষ (Upper House) প্রয়োজন নেই; বরং তা দেশের জন্য দ্বিধাত্মক ও বোঝাস্বরূপ হবে।
একটি দেশের রাজনীতি নির্ভর করে তার রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর। আমরা আশা করি, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো যথেষ্ট প্রজ্ঞা ও পরিপক্কতা প্রদর্শন করবে, যাতে তারা জাতীয় স্বার্থকে দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে স্থান দিয়ে রাজনৈতিক বোঝাপড়ার একটি নতুন সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারে।
একটি স্বাধীন ও মুক্ত সমাজ গঠনে **কূটনীতি** একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমাদের **যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক** গড়ে তুলতে হবে। কোনো এক পক্ষের দিকে হেলে পড়লে চলবে না। উভয়ের সাথেই সম্পর্ক রক্ষা করতে হলে পেশাগত পরিপক্কতা ও প্রজ্ঞার বিকল্প নেই।
**একটি জাতীয় সরকার** এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে—শুধু অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নয়, বরং দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্যও এটি জরুরি। এ জাতীয় সরকার ছয় মাসের জন্যই যথেষ্ট এবং সর্বনিম্ন সংখ্যক উপদেষ্টা দিয়েই তা পরিচালনা করা সম্ভব।
সবচেয়ে বড় কথা, **বিপ্লবের সকল অংশীজনের মধ্যে—যাদের মধ্যে বর্তমান সরকারও অন্তর্ভুক্ত—ঐক্য** একান্ত জরুরি, না হলে আবারও জাতির জন্য অন্ধকার যুগ ফিরে আসবে। **জুলাই ঘোষণা**-গুলোই হওয়া উচিত ভবিষ্যৎ পরিবর্তনের দিকনির্দেশনা—দেশ, সমাজ ও রাজনীতির প্রয়োজনে উপযোগী করে।
লেখকঃ প্রফেসর ড. এস কে আকরাম আলী
( বিশিষ্ট কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক )