অর্ক ভাদুড়ী, কলকাতাঃ
বিশ্ববিদ্যালয়ের নোটিশ বোর্ডে যাঁরা লিখছেন 'কুকুর এবং মুসলমানদের প্রবেশ নিষেধ', তাঁরা ক্যাম্পাসে শহীদ সেনা কমান্ডো ঝন্টু আলি শেখকে ঢুকতে দিতে চান না। নদীয়ার ছেলে ঝন্টু আলি শেখের রক্তের দাগ এখনও উধমপুরের মাটিতে লেগে আছে। পহেলগাঁও-এর নৃশংস গণহত্যার পর জঙ্গিদের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে শহীদ হয়েছেন ঝন্টু৷
আমাদের লজ্জা আমরা এমন একটা দেশে বাস করি যেখানে শহীদ ঝন্টুর ছবি বুকে চেপে ধরে কাঁদতে কাঁদতে মা আকালি বিবি এবং বাবা সাবুর আলিকে বলতে হয়, "ছেলে মরে প্রমাণ করল, আমরা কোন দিকে!" আমাদের লজ্জা আমরা এমন একটা দেশে বাস করি যেখানে 'কুকুর এবং মুসলমানদের' প্রবেশ নিষিদ্ধ করার দাবি তোলা লোকজন আসলে লাথি মারে সইদ আদিল হুসেন শাহের রক্তভেজা লাশে। আদিল পর্যটকদের টাট্টু ঘোড়ায় চড়াতেন। জঙ্গীরা যখন গুলি চালিয়ে পর্যটকদের হত্যা করছে, তখন একজনের হাত থেকে বন্দুক কেড়ে নিতে যান আদিল। গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যান। এই বীর শহীদ ভারতীয় যুবককেও অপমান করছে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা৷
পহেলগাঁও গণহত্যার পর প্রত্যাশিতভাবেই দেশজুড়ে তীব্র মুসলিমবিদ্বেষের চাষ শুরু হয়েছে। আরও একবার সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ হল, সংবিধানে যাই থাক, নরেন্দ্র মোদীর ভারত আদতে একটি হিন্দুরাষ্ট্র। সংখ্যালঘু জওয়ানরা দেশের জন্য যতই প্রাণ দিন, মুসলিমদের 'দেশদ্রোহী' প্রমাণ করার সংগঠিত প্রচেষ্টা বন্ধ হবে না। কারণ এটাই বিজেপি-আরএসএসের রাজনৈতিক প্রকল্প। ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের ভিত্তি হল আমাদের সংবিধান৷ সেই 'ধর্মনিরপেক্ষ' সংবিধান বদলে ফেলার দাবি উঠছে টেলিভিশনের সান্ধ্য খেউড়ের আসরে। অথচ অতিদক্ষিণপন্থী প্রচার-মেশিনগুলির গায়ে দেশবিরোধী তকমা লাগে না!
কাশ্মীরে নিরস্ত্র পর্যটকদের যে সন্ত্রাসবাদীরা নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করেছে, তাদের কোনও ক্ষমা নেই৷ তারা কাশ্মীরের শত্রু, কাশ্মীরীদের শত্রু, গোটা মানবসভ্যতার দুশমন। কেন্দ্রীয় সরকার দ্রুত সন্ত্রাসবাদ দমন করুক। কঠোর ব্যবস্থা নিক। কিন্তু একইসঙ্গে এই প্রশ্নেরও উত্তর সরকারকে দিতে হবে, পর্যটকদের জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব কার ছিল? সরকারের নয়? নিরাপত্তা গাফিলতির দায় কে নেবেন? কাদের আশ্বাসবাণীতে ভরসা করে পর্যটকরা কাশ্মীরে গিয়েছিলেন?
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বার বার বলেছেন, তাঁরা ৩৭০ তুলে দিয়ে সন্ত্রাসবাদের কোমর ভেঙে দিয়েছেন, কাশ্মীর এখন সম্পূর্ণ নিরাপদ। সেই কথায় ভরসা করেই তো মানুষগুলো ভিড় জমিয়েছিলেন কাশ্মীরে! তাহলে কি আমাদের দেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা সত্যিটা বলেননি? অতিরঞ্জিত তথ্য দিয়েছিলেন? এই নৃশংস গণহত্যার দায় মোদী-শাহ নেবেন না? ২০০৮ সালে যখন ২৬/১১ ঘটেছিল, তখন কিন্তু তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শিবরাজ পাটিল দায় নিয়ে পদত্যাগ করেছিলেন। এবার কে পদত্যাগ করবেন? কেন করবেন না?
মোদী সরকারের আমলে একটার পর একটা জঙ্গী হামলা হয়েছে- কখনও পাঠানকোটে, কখনও উরিতে, কখনও পুলওয়ামায়। এবার পহেলগাঁওতে একঝাঁক নিরস্ত্র পর্যটকের প্রাণ গেল। সরকার কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছিল? নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ কি নিহত পর্যটকদের আত্মীয়দের হাহাকার শুনতে পান না? স্বজনহারানো মানুষগুলো বার বার নিরাপত্তার অভাবের কথা বলছেন, দায়ী করছেন কেন্দ্রীয় সরকারকে। এই অপরিসীম ব্যর্থতার দায় নিয়ে নতমস্তকে ক্ষমা চাইবেন না মোদী-শাহ? পদত্যাগ করবেন না?
জঙ্গীবাদ রুখতে, জওয়ানদের প্রাণ বাঁচাতে, নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বার বার ব্যর্থ হয়েছে নরেন্দ্র মোদীর সরকার। সেই অপদার্থতা আড়াল করতেই মুসলিমবিদ্বেষের হাওয়া তোলা হচ্ছে। মুসলিমদের হত্যাযোগ্য করে তোলার আয়োজন চলছে। অথচ নৃশংস জঙ্গীহানার পরে গোটা কাশ্মীর প্রতিবাদে, ধিক্কারে নেমে এসেছে রাজপথে। হাজার হাজার সাধারণ কাশ্মীরী, যাঁদের অধিকাংশই ধর্মে মুসলমান, প্রাণপণে ধিক্কার জানিয়েছেন সন্ত্রাসবাদীদের। অথচ ঘৃণার কারবারিরা প্রচার করছেন সন্ত্রাসবাদী মানেই মুসলিম। তাই বুঝি? তাহলে মালেগাঁও বিস্ফোরণ যারা ঘটিয়েছিল, তাদের কী বলবেন? এখন তো সেকুলারদের সরকার নেই, নিখাদ হিন্দুত্ববাদীদের সরকার। সম্প্রতি জাতীয় তদন্ত সংস্থা (এনআইএ) মালেগাঁও বিস্ফোরণ কাণ্ডে বিজেপি নেত্রী তথা প্রাক্তন সাংসদ সাধ্বী প্রজ্ঞা সিং ঠাকুরের মৃত্যুদণ্ড-সহ সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়ে আদালতের কাছে আবেদন করেছে। সাধ্বী প্রজ্ঞা কি মুসলিম? এই দেশে লস্কর-ই তৈবার যেমন কোনও ঠাঁই নেই, ঠিক তেমনই সাধ্বী প্রজ্ঞারও ঠাঁই নেই।
মাঝেমধ্যে এমন সময় আসে, যখন ঝুঁকি নিতে হয়। ঝুঁকি নিয়েই সত্যের পক্ষে, ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে হয়৷ নাহলে নিজের কাছেই খুব ছোট হয়ে যেতে হয়। এখন তেমনই সময়৷ এই দেশটা হিন্দুর, এই দেশটা মুসলমানেরও৷ এই দেশটা বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, জৈন, নাস্তিক- সকলের। এই দেশকে স্বাধীন করতে ফাঁসির দড়িতে ঝুলেছেন ভগৎ সিং, ক্ষুদিরাম বসুর মতোই শহীদ আসফাকউল্লা খান। এখনও শহীদ হচ্ছেন ঝন্টু আলি শেখের মতো বীর জওয়ান। এই দেশ ভারতরত্ন মৌলানা আবুল কালাম আজাদের দেশ। যাঁরা এই দেশের প্রাণসত্তাকে খতম করতে চাইছেন, তাঁরা সফল হবেন না। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে আমরা, ভারতের জনগণ সাংবিধানিক ধর্মনিরপেক্ষতাকে রক্ষা করব।
লেখাঃ সাংবাদিক অর্ক ভাদুড়ী
( মুক্ত বাংলা টিভি, কলকাতা )