শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক: বাংলার মাটি ও মানুষের চিরকালীন নেতা
আজ ২৬ অক্টোবর, বাংলার মাটি ও মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু, শোষিত-বঞ্চিত জনগণের ত্রাণকর্তা শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের ১৫২তম জন্মবার্ষিকী।
১৮৭৩ সালের এই দিনে বরিশাল বিভাগের ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তাঁর নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলার কৃষক, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের ইতিহাস।
বাংলার রাজনীতির ইতিহাসে শেরে বাংলা এমন এক নাম, যিনি কেবল একজন রাজনীতিবিদই নন— ছিলেন শিক্ষাবিদ, আইনজ্ঞ, সমাজসংস্কারক ও মানবতাবাদী নেতা। তাঁর কর্ম ও দর্শন আজও রাজনীতিতে মানবতার আলো জ্বেলে রাখে।
জন্ম ও শৈশব:
১৮৭৩ সালের ২৬ অক্টোবর, রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়া ইউনিয়নের মিঞাবাড়িতে জন্ম নেন আবুল কাশেম ফজলুল হক।
তাঁর আদি নিবাস ছিল বরিশালের বানারীপাড়ার চাখার গ্রামে এবং পৈতৃক সূত্রে সম্পর্ক ছিল পটুয়াখালীর বাউফলের বিলবিলাস গ্রামের সঙ্গে।
পিতা কাজী মুহম্মদ ওয়াজেদ ছিলেন সমাজপতি ও আলেম; মাতা সাইদুন্নেসা খাতুন ছিলেন শিক্ষানুরাগী ও ধর্মপ্রাণ নারী। ছোটবেলা থেকেই ফজলুল হক ছিলেন মেধাবী, আত্মবিশ্বাসী ও ন্যায়ের পক্ষে নির্ভীক।
শিক্ষাজীবন:
এক প্রতিভার উজ্জ্বল বিকাশ প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পর ১৮৮১ সালে ভর্তি হন বরিশাল জিলা স্কুলে। ১৮৮৯ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় ঢাকা বিভাগে মুসলমানদের মধ্যে প্রথম স্থান অর্জন করেন— যা সে সময় বিরল অর্জন।
এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমান কলকাতায়।
কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে গণিত, রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞানে অনার্সসহ ১৮৯৩ সালে বিএ প্রথম শ্রেণিতে পাস করেন।
পরে গণিতে এমএ এবং আইনশাস্ত্রে বি.এল ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর একাডেমিক জীবন ছিল যুগান্তকারী— প্রমাণ করেছিলেন, প্রতিভা ও পরিশ্রমই শিক্ষার মূল শক্তি।
রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ:
১৯০৬ সালে ঢাকায় অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা সম্মেলনে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে তাঁর রাজনীতিতে প্রবেশ। দ্রুতই তিনি হয়ে ওঠেন দলের সংগঠক ও প্রভাবশালী নেতা। তবে তাঁর রাজনীতি দলীয় সীমার বাইরে—
তিনি বিশ্বাস করতেন, “রাজনীতি মানে মানুষের কল্যাণ ও মর্যাদা রক্ষা।”
বাংলার মুখ্যমন্ত্রী:
জনমানুষের ত্রাণকর্তা ১৯৩৭ সালে শেরে বাংলা বাংলার মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন।
এই সময়েই তিনি জনগণের আসল বন্ধু হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন।
তাঁর ঐতিহাসিক সংস্কার ও উদ্যোগসমূহ:
কৃষক প্রজার আইন প্রণয়ন করে জমিদারদের অন্যায় দমন , বিনামূল্যে প্রাথমিক শিক্ষা চালু, মুসলমানদের জন্য শিক্ষায় ও চাকরিতে সংরক্ষণ নীতি, গ্রামীণ অর্থনীতি ও কৃষিভিত্তিক উন্নয়ন কর্মসূচি|
জনগণের ভাষায় তিনি ছিলেন “মাটির মানুষ”। তাঁর ন্যায়নিষ্ঠা ও মানবিকতা তাঁকে “শেরে বাংলা” — অর্থাৎ বাংলার বাঘ উপাধি এনে দেয়।
লাহোর প্রস্তাব: পাকিস্তান আন্দোলনের ভিত্তি
১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোরে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের অধিবেশনে তিনি যে প্রস্তাব উপস্থাপন করেন, তা-ই ইতিহাসে “লাহোর প্রস্তাব” বা “পাকিস্তান রেজোলিউশন” নামে পরিচিত।
এই প্রস্তাবই পরবর্তীতে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তি স্থাপন করে।
তবে শেরে বাংলার লক্ষ্য ছিল বিভাজন নয়, বরং মুসলমান ও নিপীড়িত মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা।
যুক্তফ্রন্ট ও জনগণের বিজয়:
১৯৫৪ সালে শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানীর সঙ্গে মিলে তিনি যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন।
সেই নির্বাচনে বাংলার মানুষ প্রথমবারের মতো নিজেদের প্রতিনিধি হিসেবে জয়লাভ করে।
তাঁদের স্লোগান ছিল—
“রুটি, কাপড় ও বাসস্থান— বাংলার মানুষের মৌলিক অধিকার।”
এই স্লোগান আজও সামাজিক ন্যায়বিচার ও জনগণের রাজনীতির প্রতীক।
শেষ জীবন ও চিরন্তন স্মৃতি:
১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক পরলোকগমন করেন।
তাঁকে ঢাকার শেরে বাংলা নগরে সমাধিস্থ করা হয়।
পরবর্তীতে তাঁর পাশে শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও খাজা নাজিমুদ্দিনের সমাধি নির্মিত হয়— যা এখন পরিচিত “তিন নেতার মাজার” নামে।
দর্শন ও উত্তরাধিকার:
শেরে বাংলার দর্শন ছিল মানবতাবাদী রাজনীতি। তিনি বলেছিলেন— “যে জাতি তার কৃষক-শ্রমিককে অবহেলা করে, সে জাতি কখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না।” আজও তাঁর এই বাণী রাষ্ট্রনীতি ও সামাজিক ন্যায়ের দিশারী।
তাঁর জীবন আমাদের শেখায় রাজনীতি ক্ষমতার নয়, মানুষের সেবার পথ।
বাংলাদেশ যখন ন্যায়, সাম্য ও উন্নয়নের পথে এগিয়ে চলেছে—তখন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের জীবন ও আদর্শই আমাদের অনুপ্রেরণার চিরন্তন উৎস।
নতুন প্রজন্মের প্রতি তাঁর বার্তা আজও প্রাসঙ্গিক— “মানুষের কল্যাণে রাজনীতি না থাকলে, সেই রাজনীতি অমানবিক।”
বাংলার ইতিহাসের আকাশে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এক অমর নক্ষত্র—
যিনি ছিলেন, আছেন, থাকবেন— বাংলার মাটি ও মানুষের হৃদয়ে।
মো.মঞ্জুর হোসেন ঈসা
মহাসচিব
ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি- এনডিপি