রাজনীতি একটি দেশের শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত এবং এটি গণতান্ত্রিক সমাজে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রাজনীতির ভুল কেবল কোনো একটি রাজনৈতিক দলের পতন ডেকে আনে না, বরং সেই দলের ভুলের কারণে পুরো জাতি ভোগান্তির শিকার হয়।
বাংলাদেশের জনগণ অতীতে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতের ভুল রাজনীতির কারণে তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছে। এসব ভুলের জন্য দায়ী জনগণ নয়— দায়ী রাজনীতির কর্ণধাররা।
আওয়ামী লীগের জন্ম হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সেবা করার মহান উদ্দেশ্য নিয়ে। হাসান শহীদ সোহরাওয়ার্দীও পরবর্তীতে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু তাঁর অনুপস্থিতিতে দলের মধ্যে বামপন্থী ধারা প্রভাব বিস্তার করে এবং তারা ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদকে জনপ্রিয় করার চেষ্টা চালায়। যদিও শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ডানপন্থী গোষ্ঠী দলকে রাজনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখে ও জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
সময়ের পরিক্রমায় ভারত গোপনে আওয়ামী লীগের ভেতরে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয় এবং শেখ মুজিবও তাঁদের দ্বারা প্রভাবিত হন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাও এ মতের পক্ষে সাক্ষ্য দেয়। শেখ মুজিব নিজেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তাঁর সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করেন। এভাবেই ভারতের প্রত্যক্ষ ভূমিকার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সৃষ্টি ঘটে।
আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক খেলাটি ভারতের প্রভাবাধীন ভুল নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল, এবং শেখ মুজিব নিজেও তা বুঝে উঠতে পারেননি। ক্ষমতার মোহে তিনি ধীরে ধীরে ভারতের রাজনৈতিক ক্রীড়নকে পরিণত হন। যদিও তাঁর উদ্দেশ্য পাকিস্তান ভাঙা ছিল না, কিন্তু তিনি তাঁর দলের বিপ্লবী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ হারান। সেই বিপ্লবী গোষ্ঠীর সফলতার মধ্য দিয়েই ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।
স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগের ভুল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত দেশকে একদলীয় শাসনের দিকে ঠেলে দেয়। শেখ মুজিব গণতন্ত্রের প্রবক্তা ছিলেন বটে, কিন্তু দিল্লি–মস্কোর কূটনীতির ফাঁদে পড়ে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী নীতি গ্রহণ করে বাকশাল প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর এই ভুল রাজনীতি শুধু তাঁর পতনই নয়, তাঁর প্রাণহানির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
শেখ মুজিবের পতনের পর জিয়াউর রহমানের উত্থান জাতির জন্য আশীর্বাদস্বরূপ প্রমাণিত হয়। তিনি বাংলাদেশের একজন মহান নেতা ও রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁর দূরদর্শিতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার ফলেই বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর জন্ম হয়, যা দেশের গণতান্ত্রিক অনুশীলনকে উৎসাহিত করে।
যদিও বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, পরবর্তীতে বেগম খালেদা জিয়ার দক্ষ নেতৃত্বে দলটি একটি জনপ্রিয় জাতীয়তাবাদী শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তিনবার তিনি দলকে ক্ষমতায় আনেন, কিন্তু কিছু ভুল রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে বিএনপি ক্ষমতা হারায়। তবুও তিনি জাতীয় স্বার্থে আপস না করে কারাভোগ করেছেন, আর তাঁর সাহসী অবস্থান তাঁকে বাংলাদেশের নিরঙ্কুশ জাতীয় নেত্রীতে পরিণত করেছে।
গত পনের বছরে বিএনপির অসংখ্য নেতা-কর্মী নিপীড়ন, মামলা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, কিন্তু দলত্যাগ করেননি।
সম্প্রতি শেখ হাসিনা গণঅভ্যুত্থানের মুখে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন, কারণ তিনি ক্ষমতায় টিকে থাকতে ভুল পথে হেঁটেছিলেন। আওয়ামী লীগ কখনো জনগণের অনুভূতি বা আকাঙ্ক্ষাকে গুরুত্ব দেয়নি। শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনা দুজনেরই রাজনৈতিক পরিণতি ছিল একই — ভুল রাজনীতির করুণ ফলাফল।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী অতীতে কিছু ভুল সিদ্ধান্তের জন্য সমালোচিত হলেও কখনো তাদের রাজনৈতিক বিশ্বাস ও আদর্শ থেকে সরে যায়নি। অনেকেই মনে করেন, ১৯৭১ সালে তাদের রাজনৈতিক অবস্থান পুরোপুরি ভুল ছিল না, কিন্তু এরশাদ আমলে তাদের ভূমিকা এবং ১৯৯৬ সালের আন্দোলনে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করা নিঃসন্দেহে ভুল রাজনৈতিক পদক্ষেপ ছিল। ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবের পর তারা একটি জনপ্রিয় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে পুনরায় আবির্ভূত হয়েছে, তবে এখন তাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে বর্তমান রাজনৈতিক আচরণের ওপর। এই পর্যায়ে এসে তাদের ভুল করার কোনো সুযোগ নেই।
বিএনপির রাজনীতিও চ্যালেঞ্জমুক্ত নয়। দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। শীর্ষ নেতৃত্বকে সতর্ক থাকতে হবে, বিশেষ করে যারা অতীতে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করেছে, দলবিরোধী কার্যক্রমে লিপ্ত ছিল এবং যাদের বহিষ্কার করা হয়েছে—তাদের পুনর্বহাল করা উচিত নয়।
গুজব রয়েছে যে অতীতে দলবিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য বহিষ্কৃত কিছু নেতা আবার দলে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে, এমনকি তাদের আগামী নির্বাচনে মনোনয়নেরও ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে নজরুল ইসলাম মঞ্জু (খুলনা-২), ফজলুর রহমান (কিশোরগঞ্জ-৪) ও রুহুল আমিন দুলাল (পিরোজপুর-৩) মনোনয়ন পেয়েছেন বলে খবর ছড়িয়েছে।
এই সংবাদে সারাদেশে আলোচনা শুরু হয়েছে, বিশেষ করে খুলনার জনগণ এ খবর শুনে হতাশ ও ক্ষুব্ধ। তারা চেয়েছিল এলাকার যোগ্য, স্থানীয় একজন প্রার্থীকে। তাঁদের আশা-আকাঙ্ক্ষা উপেক্ষা করে শীর্ষ নেতৃত্ব যদি বহিষ্কৃতদের মনোনয়ন দেয়, তবে তা স্থানীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে ভুল বার্তা দেবে এবং দীর্ঘমেয়াদে দলের ভাবমূর্তির ক্ষতি করবে।
এখনই বিএনপির সতর্ক হওয়ার সময়। শীর্ষ নেতৃত্বকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে আরও বিচক্ষণ হতে হবে। অতীতে যেমন ভুল সিদ্ধান্ত দলকে সঙ্কটে ফেলেছে, ভবিষ্যতে তেমন কোনো ভুলের পুনরাবৃত্তি হওয়া চলবে না। যদি কোনো সিদ্ধান্ত ভুল প্রমাণিত হয়, তা দ্রুত সংশোধন করতে হবে। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে জটিল, তাই বিএনপিকে এখন সর্বোচ্চ প্রজ্ঞা, সতর্কতা ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার সঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে।
ভুল রাজনীতি কখনোই শুভ পরিণতি আনে না — না দলের জন্য, না দেশের জন্য।
লেখকঃ প্রফেসর ড. এস কে আকরাম আলী
( বিশিষ্ট কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক )