আমাদের এই উপমহাদেশে কিছু জাতি-বর্ণ-পেশার পরিচয়ের (সংখ্যালঘু) মানুষরা এখনো বৈষম্যের শিকার। যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে দলিত-হরিজন সম্প্রদায়। প্রায় বেশ কয়েকটি জাত-পেশার সংমিশ্রণে এই সম্প্রদায় গঠিত। দলিত সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশের পেশা হচ্ছে পরিচ্ছন্নতা কর্মী। যদিও বংশপরম্পরায় তারা এই পেশায় নিয়োজিত। বিভিন্ন কাজের সুযোগ থাকার পরেও তারা বাপ-দাদাদের স্মৃতির বাহক হিসেবে পেশাটি ধরে রেখেছে।
দেশের মোট জনসংখ্যার ২৫ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। এর ৬ শতাংশই দলিত জনগোষ্ঠী। কিন্তু সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে বৈষম্যের শিকার হন তারা। উইকিপিডিয়া-এর তথ্যমতে, বাংলাদেশে দলিত সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা প্রায় ৬৫ লাখ (সবচেয়ে বেশি ভারতে প্রায় ২০ কোটি)। বাঙালি দলিত বলতে বোঝায় : চর্মকার, মালাকার, কামার, কুমার, জেলে, পাটনী, কায়পুত্র, কৈবর্ত, কলু, কোল, কাহার, ক্ষৌরকার, নিকারী, পাত্র, বাউলিয়া, ভগবানীয়া, মানতা, মালো, মৌয়াল, মাহাতো, রজদাস, রাজবংশী, রানা কর্মকার, রায়, শব্দকর, শবর, সন্ন্যাসী, কর্তাভজা, হাজরা প্রভৃতি সম্প্রদায়। এই সব সম্প্রদায় আবার বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত। ইসলাম ধর্ম জাতিভেদকে অস্বীকার করলেও তাদের মধ্যে বিরাজমান সম্প্রদায় হচ্ছে : জোলা, হাজাম, বেদে, বাওয়ালী।
তাদের ওপর হামলা, তাদের ঘরবাড়িতে দখলদারিত্ব চালানো, সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা ইত্যাদি খবর আমরা গণমাধ্যমে দেখে থাকি। অথচ বৃহৎ এই জনগোষ্ঠী আমাদের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় নাগরিক এবং ব্যক্তিগত সেবা প্রদান করে আসছে।
ঢাকা শহরের মিরনজিল্লা সিটি কলোনি হচ্ছে দলিত পরিবারগুলোর আশ্রয়স্থল। তারা শত শত বছর ধরে এই অঞ্চলে বসবাস করে আসছে। মহান মুক্তিযুদ্ধসহ দেশের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনেও তাদের অবদান ভুলবার মতো নয়।
২০২৪ সালে এই জনগোষ্ঠীর ওপর ক্ষমতাসীন ও সংখ্যাগুরুদের নিপীড়ন-অত্যাচার বেড়ে যায়। তাদের বসতভিটা দখল করার জন্য হরিজনদের নামে মিথ্যা মামলাও করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর। গত বছরের জুলাই মাসে হরিজন সম্প্রদায়ের মা-বোনদের ওপর অত্যাচার এবং উপাসনালয়ে আঘাত করে বলে জানান মিরনজিল্লার বাসিন্দারা। তাদের অভিযোগ, সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ বারবার উচ্ছেদ অভিযান চালায় তাদের বসতভিটায়। মিরনজিল্লা হরিজন সম্প্রদায়ের মানুষেরা উচ্ছেদ অভিযান প্রতিহত করতে গেলে তাদের উপর হামলা করে মামলা দেয় সিটি করপোরেশন।
হরিজনরা শুধু পরিচ্ছন্নতা কর্মী নয়, তারাও মানুষ এই বোধটুকু আজও সমাজে বাস্তবায়ন হয়নি। একটা সময় ছিল যখন বর্ণ, পেশা, জাত নিয়ে বিবেচনা করা হতো। তবে সমাজে এই বিভেদটা কমলেও কিছু ক্ষেত্রে এর সংকট এখনো লক্ষণীয়।
চলতি নভেম্বর মাসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। সেখানে দেখা যায় গাইবান্ধার মহিমাগঞ্জের এক চা দোকানে অনিতা বাসফোর নামে এক মেয়ে চা খেতে গেলে তাকে চা এর গ্লাসের বদলে পলিথিনে চা খেতে দেওয়া হয়। গোবিন্দগঞ্জে অনুষ্ঠিত এক প্রতিবাদ সমাবেশে অনিতা বাসফোর সাংবাদিকদের বলেন, ‘শুধু চা দোকান নয়, এরকম বহু স্থানে আমাদের বাধার সম্মুখীন হতে হয়। আমাদের সম্প্রদায়ের সঙ্গে স্থানীয়রা মেলামেশাও কম করে। আমরা পরিচ্ছন্নতা কর্মী বলে আমাদের সবাই আলাদা চোখে দেখে। জন্মই যেন আমাদের আজন্ম পাপ।’
মানুষ মানুষে বিভেদ এটা ভয়ংকর। জাত-পাত কিংবা ধর্ম-পেশা দিয়ে মানুষকে বিবেচনা করাও ঠিক না। হরিজন-দলিত মানুষেরা সমাজে বাস করেও তাদের নেই কোনো মানবিক মর্যাদা। সমাজের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিই এর কারণ বলে মনে করেন- নারী অধিকার কর্মী শোভা রাণী প্রমাণিক।
ঢাকা কিংবা গাইবান্ধা নয়, এরকম সংকট-বৈষম্যের উদাহরণ দেশের প্রতিটি জেলায়। তারা শুধু সামাজিক অধিকার ও সমাজ বিচ্যুত নয়, এদেশের বাসিন্দা হবার পরেও কিনতে পারেন না জমি-ভিটা। ভিন্ন গ্রামে গিয়ে জমি ক্রয় করলেও তাদের বংশ-কর্ম পরিচয় শুনে জমি বিক্রি করতে অনীহা প্রকাশ করে মালিকপক্ষ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত যারা বসতবাড়ি বানিয়ে আছেন তাদের অধিকাংশ সরকারি খাসজমি। মাঝে মধ্যে সেই সরকারি খাসজমি দখল ও ভাঙচুরের চেষ্টা চালায় ক্ষমতাসীন মহল।
চলতি বছরের পহেলা নভেম্বর রাজধানীতে অনুষ্ঠিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক কনভেনশনে জাতীয় অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘মর্যাদা ও অধিকারের জন্য দেশের নিপীড়িত জনগোষ্ঠী রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা অধিকার না করলে একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ সম্ভব নয়। তাই বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণে নিপীড়িত মানুষের ঐক্যবদ্ধ লড়াই জরুরি।’
রাজনৈতিক-সামাজিক নানামুখী সংকট-বৈষম্যের পরেও এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠী চোখ তুলে দাঁড়াচ্ছে। তারাও সমাজের সঙ্গে লড়তে শিখছে। তারাও এখন পড়াশোনা, চাকরিতে সফলতার স্বাক্ষর রাখছে। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার এর মতো পেশায় নিয়োজিত হচ্ছে তাদের সন্তানেরা।
সমাজের এত বাধা বিপত্তি পাড়ি দিয়েও সফলতার উদাহরণ হয়ে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে- গনকটুলি সিটি কলোনির বাসিন্দা বিজয়তি কেশ, মিরনজিল্লা সিটি কলোনীর বাসিন্তা পূজা রাণী দাস, গাবতলী সিটি দলিত কলোনীর সরস্বতী দাস ও গোপীবাগ দলিত সিটি কলোনীর মাররা ইশরাম্মা। তারা কর্মক্ষেত্রে সফলতার সঙ্গে কাজের পাশাপাশি নিজের সম্প্রদায়ের উন্নয়ন, শিক্ষা নিয়েও সামাজিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছেন। সফল ব্যক্তির তালিকায় তাদের নাম সংখ্যায় কম হলেও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর উদ্যোগ, চেষ্টা ও মেধার প্রতিফলত ঘটবে এমনটাই প্রত্যাশা সচেতন নাগরিক সমাজের।
লেখক : শুভ চন্দ্র শীল, সাংবাদিক ও বিশ্লেষক।